রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম বিভাগে গত আট মাসে ২৫টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে, আহত হয়েছে শতাধিক। রেলের অব্যবস্থাপনা, ট্রেনিং না দিয়ে কাজ করানো ও অপরাধের শাস্তির না হওয়ায় বারবার এমন দুর্ঘটনা ঘটছে। এসব দুর্ঘটনার পর তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে চলে নানান লুকোচুরি। ফলে অপরাধ করেও অনেকে পার পেয়ে যায়। আবার দক্ষ জনবল না থাকায় দোষীদের তেমন কঠিন শাস্তিও দেওয়া যায় না।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের পরিবহন সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩ সালে ১৮টি ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে। তবে তাদের তালিকায় তিনজন নিহতের বিষয়টি উল্লেখ নেই। এছাড়া ২০২৪ সালের জানুয়ারি ৫টি ও ফেব্রুয়ারি মাসে ঘটেছে ২টি ট্রেন দুর্ঘটনা।
২০২৩ সালে ১৮ দুর্ঘটনা
২০২৩ সালের ২৩ জুন সাগরিকা ও কর্ণফুলী রেকের একটি কোচ লাইনচ্যুত হয়। এরপর ৬ জুলাই নিউমুরিং শান্টিং ইঞ্জিন লাইনচ্যুত হয়। ১১ জুলাই ফৌজদারহাটে লাইনচ্যুত হয় ইঞ্জিন।
এরপর ৩ আগস্ট ফৌজদারহাটে একটি বগি লাইনচ্যুত হয়। ১৭ আগস্ট ষোলশহর সেনানিবাস এলাকায় একটি তেলবাহী লাইনচ্যুত। ১৯ আগস্ট সিজিপিওয়াই (গুডস পোর্ট ইয়ার্ড) বন্দরে একটি বগি লাইনচ্যুত হয়।
এছাড়া ২৭ আগস্ট সীতাকুণ্ডের ফকিরহাটে সোনার বাংলা ট্রেনের সঙ্গে পুলিশ পিকআপের সংঘর্ষ। এ ঘটনায় তিন পুলিশ কনস্টেবল নিহত হয়। নিহতরা হলেন কনস্টেবল মিজান, ইস্কান্দার ও হোসাইন। এরপর ২৯ আগস্ট সীতাকুণ্ডের কুমিরাতে কন্টেইনারবাহী বগি লাইনচ্যুত হয়। ৩০ আগস্ট একটি বগি লাইনচ্যুত হয় পাহাড়তলী মার্শালিং ইয়ার্ডে।
১১ সেপ্টেম্বর সিজিপিওয়াই বন্দরে একটি বগি লাইনচ্যুত হয়। ৪ অক্টোবর কুমিল্লা রসুলপুরে স্লিপারবাহী বগি লাইনচ্যুত হয়।
৯ নভেম্বর নিউমুরিংয়ে খাদ্যবাহী কন্টেইনার পরিবহন করা বগি লাইনচ্যুত হয়। এরপর ২০ নভেম্বর সিজিপিওয়াই বন্দরে লাইনচ্যুত হয় একটি লাগেজভ্যান। দুদিন পর ২২ নভেম্বর পাহাড়তলী মার্শালিং ইয়ার্ডে একটি কোচ লাইনচ্যুত হয়।
৩ ডিসেম্বর সীতাকুণ্ড বড়তাকিয়ায় লাইনচ্যুত হয় ট্রেনের একটি বগি। ৭ ডিসেম্বর পাহাড়তলী এলাকায় একটি ইঞ্জিন লাইনচ্যুত হয়। ২৮ ডিসেম্বর সিজিপিওয়াই বন্দরে একটি লাগেজভ্যান লাইনচ্যুত হয়। ৩০ ডিসেম্বর কুমিল্লা গুণবতী স্টেশন এলাকায় কন্টেইনার বগি লাইনচ্যুত হয়।
গত দু’মাসে ৭ দুর্ঘটনা
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সাতটি ট্রেন দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম বিভাগে।
১ জানুয়ারি সীতাকুণ্ডের কুমিরা এলাকায় একটি কোচ লাইনচ্যুত হয়। ৮ জানুয়ারি চিনকি আস্তানা এলাকায় লাইনচ্যুত হয় একটি কন্টেইনার বগি। ১৭ জানুয়ারি দোহাজারী এলাকায় একটি ইঞ্জিন লাইনচ্যুত হয়। ২২ জানুয়ারি রামু ইসলামাবাদ এলাকায় ইঞ্জিন ও গ্যাং কার সংঘর্ষ হয়। ৩০ জানুয়ারি সিজিপিওয়াই বন্দরে লাইনচ্যুত কন্টেইনারবাহী ট্রেন। মেকানিক্যাল বিভাগের অবহেলায় এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
এরপর ৭ ফেব্রুয়ারি ফৌজদারহাট স্টেশনের কাছে কর্ণফুলী এক্সপ্রেসের সঙ্গে একটি শান্টিং ইঞ্জিনের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে চালকসহ অর্ধশত যাত্রী আহত হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্টেশন মাস্টারের অনভিজ্ঞতাই দুর্ঘটনার কারণ। স্টেশনমাস্টার মো. হারুনকে ২০২২ সালে ডিসেম্বরে চট্টগ্রাম বন্দর রেলওয়ে স্টেশনে যোগ দেওয়ার এক বছর তিন মাসের মাথায় ফৌজদারহাটে আসেন। এ কাজে তার প্রশিক্ষণ ছিল না।
এছাড়া এখানে গার্ড এবং পিম্যানের দায়ও রয়েছে। ট্রেন শান্টিংয়ের সময় একজন গার্ড ও পিম্যান উপস্থিত রাখা নিয়ম হলেও তা মানা হয়নি ওই দুর্ঘটনার আগে। ফলে ট্রেনের সঙ্গে ইঞ্জিনের সংঘর্ষ হয়।
এরপর ১০ ফেব্রুয়ারি ফেনী এলাকায় সাগরিকা ট্রেনের একটি বগি লাইনচ্যুত হয়।
এদিকে ফৌজদাহাট স্টেশনে দুর্ঘটনার বিষয়ে জানে চাইলে তদন্ত কমিটির সদস্য বিভাগীয় প্রকৌশলী-১ আবদুল হানিফ বলেন, ‘আমরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বিস্তারিত খোঁজ নিয়েছি। সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কথা বলেছি। শীঘ্রই বিভাগীয় ব্যবস্থাপকের (ডিআরএম)কাছে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ডিআরএম মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘রেলভ্রমণ জনপ্রিয় করতে মন্ত্রণালয় নানা ধরনের পদক্ষেপ নেয়। চালক ও গার্ডদের গাফেলতি ছাড়াও যান্ত্রিক ত্রুটির কারণেও দুর্ঘটনা হয়। আমরা যতদূর সম্ভব তদন্ত করে পদক্ষেপ নিই। ফৌজদারহাট দূর্ঘনার বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করেছি। শীঘ্রই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে। যাদের অবহেলায় দুর্ঘটনা, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
অবহেলায় দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে কিনা, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অভিজ্ঞ জনবল সংকটের কারণে দোষীদের কঠিন শাস্তি দেওয়া যায় না। এজন্য সাময়িক বহিষ্কার বা বেতন আটকানোর মতো শাস্তি দেওয়া হয়।’