ডিএসসিসি মেয়রের দুর্নীতি

নিয়োগ থেকে বাজেট সবই চলত তাপসের ইশারায়

নিয়োগ থেকে বাজেট সবই চলত তাপসের ইশারায়

গত ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) নগর ভবন চলত সাবেক মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের ইশারায়। নিয়োগ থেকে বাজেট, প্রকল্প পরিকল্পনা থেকে বাস্তবায়ন, সব কিছুতে তার সিদ্ধান্তই ছিল চূড়ান্ত। নিয়োগ কমিটি, প্রকল্প গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন কমিটি থাকলেও তা ছিল শুধু লোক-দেখানো। সিটি করপোরেশনের টাকা নিজের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে রাখা, পছন্দের দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়োগ দেওয়াসহ বর্তমানে অসংখ্য অভিযোগ উঠছে তার বিরুদ্ধে।

অবশ্য ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ক্ষমতাধর এই সাবেক মেয়রের অবস্থান আর নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে কিছু সূত্র বলছে, বর্তমানে তিনি সিঙ্গাপুরে আত্মগোপনে আছেন।

ক্ষমতায় বাড়ত প্রকল্প ব্যয়
সংস্কারের নামে দীর্ঘদিন ফেলে রাখা হয়েছে শাহবাগ শিশু পার্ক। ২০১৮ সালে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে একটি চিঠি পাঠানো হয় ডিএসসিসিতে।

চিঠিতে প্রস্তাব দেওয়া হয়, পার্কটি সংস্কার ও আধুনিকায়নে একটি প্রকল্পের আওতায় ডিএসসিসিকে ৭৮ কোটি টাকা দেবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। প্রস্তাবটি তখনকার মেয়র ফেরত দিয়েছিলেন। তবে ২০২০ সালের মে মাসে শেখ ফজলে নূর তাপস নতুন মেয়রের দায়িত্ব নিলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওই প্রস্তাব তার নজরে আসে। পরে তিনি প্রস্তাবটি পাশ কাটিয়ে শিশু পার্কের আধুনিকায়নে ৬০৩ কোটি ৮১ লাখ টাকার নতুন একটি প্রকল্প তৈরি করেন।

ক্ষমতার দাপটে তাপস ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রকল্পটি অনুমোদন করিয়ে নেন। প্রকল্প পাসের সময় সিদ্ধান্ত হয়, ৬০৩ কোটি ৮১ লাখ টাকার মধ্যে সরকার দেবে ৪৮৩ কোটি টাকা। এই টাকার অর্ধেক হবে অনুদান, বাকি টাকা দেওয়া হবে ঋণ হিসেবে। আর দক্ষিণ সিটির নিজস্ব তহবিল থেকে খরচ করা হবে ১২০ কোটি টাকা।

সূত্র জানায়, মূলত সাবেক মেয়র তাপস ও ডিসিসির জ্যেষ্ঠ কয়েকজন কর্মকর্তার আগ্রহে তিন বছর (জুলাই ২০২৩ থেকে জুন ২০২৬ পর্যন্ত) মেয়াদি প্রকল্পটি নেওয়া হয়। প্রকল্পটি যাতে একনেকে দ্রুত পাস হয়, তার ব্যবস্থাও করেন তাপস। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রকল্পটির কাজে স্থবিরতা নেমে আসে।

তাপসের পছন্দ না হলে আটকে যেত নিয়োগ
তাপস মেয়র থাকার সময় গত সাড়ে চার বছরে দক্ষিণ সিটির বেশির ভাগ নিয়োগ দেওয়া হতো দলীয় বিবেচনায়। শুধু তাই নয়, প্রার্থীকে হতে হতো তার আস্থাভাজন। জানা যায়, দক্ষিণ সিটির ‘সহকারী সচিব’ পদে ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে নিয়োগ পান ধানমণ্ডি থানা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আবদুল্লাহ আসিফ। দক্ষিণ সিটির বিভিন্ন পদে আসিফের মতো অন্তত ২০০ জনের চাকরি হয়েছে দলীয় বিবেচনায়। তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ২০২০ সালের জুন থেকে ২০২৪ সালের জুলাইয়ের মধ্যে। এই সময় পর্বে তাপস দক্ষিণ সিটির মেয়রের দায়িত্বে ছিলেন।

সূত্র মতে, তাপসের সময় পর্বে দক্ষিণ সিটির বিভিন্ন পদে ৮১৩ জনকে স্থায়ী নিয়োগ দেওয়া হয়। আর অস্থায়ী নিয়োগ দেওয়া হয় আরো ২৯৬ জনকে।

এখন দক্ষিণ সিটির কর্মকর্তারা বলছেন, দলীয় বিবেচনায় যাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাদের প্রায় সবাইকে অসাধু পন্থায় লিখিত পরীক্ষায় পাস করানো হয়। তাপস মেয়র থাকার সময় গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগের ক্ষেত্রে কোন পদে কাকে নিয়োগ নেওয়া হবে সেটি তিনি নিজে চূড়ান্ত করতেন। এরপর তার পছন্দের প্রার্থীর তালিকা দিতেন দক্ষিণ সিটির সচিব আকরামুজ্জামানকে। তালিকা অনুযায়ী তিনি নিয়োগের ব্যবস্থা করতেন। তাপস মেয়রের দায়িত্ব নেওয়ার পর আকরামুজ্জামানকে প্রেষণে দক্ষিণ সিটির সচিব করা হয়। গত ৫ আগস্টের পর তিনিও আর নগর ভবনে যাননি। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর আকরামুজ্জামানকে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডে বদলি করা হয়েছে। দক্ষিণ সিটির নিয়োগের ক্ষেত্রে অনিয়মের অভিযোগের বিষয়ে জানতে আকরামুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে এ বিষয়ে তিনি কথা বলতে রাজি হয়নি।

দরপত্রে স্বচ্ছ কারসাজি
আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও মেয়রের ঘনিষ্ঠজনরা সংস্থাটির উন্নয়নকাজসহ কেনাকাটার সব কাজ করতেন। ফলে প্রতিযোগিতা ছাড়াই কারসাজি করে দক্ষিণ সিটির ৫৪০ কোটি টাকার কাজ বাগিয়ে নেন তারা। সূত্র জানায়, পছন্দের লোকসহ ক্ষেত্রবিশেষে অযোগ্যদের দিয়ে কাজ করানোয় অনেক কাজ যথাসময়ে শেষ করা যায়নি। এতে জনগণকে ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে।

জানা গেছে, কাকে কোন কাজ দেওয়া হবে তা আগেই ঠিক করা হতো। ফলে দরপত্র আহ্বানের পর নির্দিষ্ট ব্যক্তিরাই কাজ পেতেন। এই প্রক্রিয়ায় প্রায় ৩৭৫ কোটি ৮৬ লাখ টাকার উন্নয়নকাজ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। আরো ১৬৪ কোটি ৬২ লাখ টাকার কাজ বাস্তবায়নাধীন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে দক্ষিণ সিটির প্রকৌশল বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, মেয়র নিজে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীকে ডেকে কোন কাজ কাকে দিতে হবে সে নির্দেশনা দিয়ে দিতেন। পরে কাজ পাওয়া ব্যক্তি ঠিক করতেন একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। মাঠ পর্যায়ে ওই ঠিকাদার কাজ করলেও নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা মেয়রের পছন্দের ব্যক্তিকে দিয়ে দেওয়া হতো।

করপোরেশনের প্রকৌশল বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, তাপস এভাবে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফি ও সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন আহমদকে একাধিক কাজ দেন। এর মধ্যে মন্নাফিকে দেওয়া গুলিস্তান এলাকায় একটি বহুতল ভবনের দুটি বেইসমেন্ট ও একটি আন্ডারগ্রাউন্ডের নির্মাণকাজ এখনো শেষ হয়নি। এই কাজের জন্য করপোরেশন ২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াকে দেওয়া হয় ৩০ কোটি টাকার একটি কাজ।

জানা গেছে, আওয়ামী লীগের পাশাপাশি দলটির সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদেরও কাজ ভাগবাটোয়ারা করে দেওয়া হয়েছে। যেমন—১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ধানমণ্ডি লেক সংস্কারের কাজ দেওয়া হয় ঢাকা মহানগর দক্ষিণ স্বেচ্ছাসেবক লীগের কামরুল হাসানকে। এ ছাড়া তাপসের আস্থাভাজন কাউন্সিলররাও পেতেন রাস্তা সংস্কারসহ বিভিন্ন উন্নয়নকাজ। পরে এসব কাজ ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীদের দিয়ে করাতেন বেশির ভাগ কাউন্সিলর।

বিধি ভেঙে ৬ গাড়ি ব্যবহার, ব্যয় প্রায় ২ কোটি টাকা
তাপস নিজের ও পরিবারের সদস্যদের জন্য সিটি করপোরেশনের তিনটি গাড়ি ব্যবহার করতেন। এ ছাড়া বিধি ভেঙে তার দপ্তরে ছাত্রলীগ থেকে নিয়োগ পাওয়া দুই কর্মকর্তাকেও গাড়ি ব্যবহারের সুযোগ করে দেন। পাশাপাশি তার ব্যক্তিগত একজন কর্মকর্তাকেও করপোরেশনের গাড়ি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। এই ছয়টি গাড়ির পেছনে ৫১ মাসে জ্বালানি তেল বাবদ সিটি করপোরেশনের খরচ হয়েছে প্রায় দুই কোটি টাকা।

নিয়ম অনুযায়ী, মেয়রের জন্য সিটি করপোরেশন থেকে সার্বক্ষণিক একটি গাড়ি বরাদ্দ থাকে। তবে তাপস মেয়র থাকার সময় এই নিয়ম মানা হয়নি।

জানা যায়, বনানীর বাসা থেকে তাপসের জন্য প্রতিদিন দুপুরে খাবার আনতে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন থেকে একটি গাড়ি পাঠানো হতো। খাবার আনতে প্রতিদিন গাড়িটির জন্য ২০ লিটার জ্বালানি তেল (অকটেন) বরাদ্দ ছিল। শুক্র ও শনিবার ছাড়া গাড়ির জন্য মাসে বরাদ্দ ছিল ৪৪০ লিটার অকটেন। গাড়িটির পেছনে মাসে জ্বালানি বাবদ খরচ হতো ৫৫ হাজার টাকা। আর বছরে ছয় লাখ ৬০ হাজার টাকা। শুধু মেয়রের দুপুরের খাবার আনতে ৫১ মাসে জ্বালানি বাবদ খরচ হয়েছে ২৮ লাখ পাঁচ হাজার টাকা।

এসব বিষয়ে কথা বলতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মো. নজরুল ইসলাম এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমানের মোবাইল ফোনে বহুবার কল করেও তাদের মন্তব্য পাওয়া যায়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দক্ষিণ সিটির একজন কর্মকর্তা জানান, সাবেক মেয়রের দুর্নীতির বিষয়ে কথা বলে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে চান না তারা।

সৌজন্যে কালের কণ্ঠ