চলতি অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণ অনুসন্ধানের জন্য এসব প্রকল্পে অগ্রাধিকার নির্ধারণ করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু এই সরকার এসে কি করবে সে বিষয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় বা কমিশন এখনো সুনির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনা পায়নি। কাজেই প্রকল্পগুলোর বিষয়ে নতুন করে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ও দেশের কাছে ঋণ চাইতে দ্বিধায় ভুগছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। সোমবার (২৫ নভেম্বর) অনুষ্ঠেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে এসব প্রকল্পসহ সার্বিক বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) নিয়ে নতুন নির্দেশনা আসার সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর দুটি একনেক গণভবনে অনুষ্ঠিত হলেও এবারই প্রথম রাজধানীর আগারগাঁওয়ের এনইসি সম্মেলন কক্ষে বসছে একনেক বৈঠক। এতে সভাপতিত্ব করবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
নতুন প্রকল্পগুলোতে ঋণের জন্য বিশ্বব্যাংক, এডিবি, আইডিবি, জাইকা, চীন, ভারত, রাশিয়াসহ বিভিন্ন প্রচলিত এবং অপ্রচলিত উন্নয়ন সহযোগীর খোঁজ করার লক্ষ্য ছিল গত সরকারের।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ইআরডির সাবেক সচিব কাজী শফিকুল আযম শনিবার যুগান্তরকে বলেন, যে কোনো একটা পরিবর্তন আসলে সব কিছুতেই তার প্রভাব পড়াটাই স্বাভাবিক। এক্ষেত্রেও রাজনৈতিক বিবেচনায় অগ্রাধিকার দেওয়া প্রকল্প থাকলে দ্রুত যাচাই করা দরকার। তবে সব প্রকল্পই যে রাজনৈতিক বিবেচনায় হবে বিষয়টা সেরকম নাও হতে পারে। এসব প্রকল্পের তালিকা অর্থবছরের শুরুতেই উন্নয়ন সহযোগীদেরও দেওয়া হয়ে থাকে। তাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে প্রকল্পগুলোর বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমাদের যেহেতু বৈদেশিক অর্থের চাহিদা আছে, বৈদেশিক অর্থছাড়ও বাড়ানো প্রয়োজন। সরকারও বলছে বৈদেশিক ঋণ নির্ভর প্রকল্পে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সেহেতু এ নিয়ে যত দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় ততই ভালো। এতে উন্নয়ন সহযোগীদেরও বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হবে। সংশোধিত এডিপিতে হয়তো এটা ঠিক করা হবে। কিন্তু এর আগে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর উচিত সরকারের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া।
সূত্র জানায়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের এডিপিতে বৈদেশিক ঋণের ২৫৭টি নতুন উন্নয়ন প্রকল্পের অগ্রাধিকার নির্ধারণ করা হয়। ঋণদাতাদের আকৃষ্ট করতে অনুমোদন ও বরাদ্দহীনভাবে এসব প্রকল্পের একটি তালিকা দেওয়া হয়েছিল। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে ব্যয় হবে প্রায় ৯ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক ঋণ হিসাবে ধরা হয়েছে প্রায় ৬ লাখ ৩৫ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা। এগুলোর মধ্যে উচ্চ অগ্রাধিকার নির্ধারণ করা হয়েছে ২১৭টির, মধ্যম ৩৬ এবং নিম্ন অগ্রাধিকারে আছে ৪টি প্রকল্প।
জানতে চাইলে বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন শনিবার যুগান্তরকে বলেন, এখনো সুনির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনা আসেনি বলেই জানি। তবে আশা করছি সোমবার একনেক বৈঠকে হয়তো কোনো নির্দেশনা আসতে পারে। এসব প্রকল্পের বিষয়ে ইআরডি বলতে পারবে তাদের কাছে কোনো নির্দেশনা আছে কিনা। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সার্বিকভাবে এডিপিভুক্ত নতুন ও পুরাতন সব প্রকল্পের বিষয়েই দ্রুত সিদ্ধান্ত দরকার। কেননা এডিপি বাস্তবায়নে অবস্থা বেশ খারাপ।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, গত সরকারের অগ্রাধিকারে এডিপিতে যুক্ত হওয়া বৈদেশিক সহায়তা নির্ভর নতুন প্রকল্পগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হচ্ছে পরিবহণ ও যোগাযোগ খাতের ৪৮টি। এগুলো বাস্তবায়নে ঋণের প্রয়োজন হবে ২ লাখ ৭৪ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা। দ্বিতীয় অবস্থানে গৃহায়ণ ও কমিউনিটি সুবিধাবলি খাতের ৪৩ প্রকল্পের জন্য ঋণ লাগবে ১ লাখ ৫৮ হাজার ৫৬৯ কোটি টাকা। তৃতীয় স্থানে থাকা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ৪২টি প্রকল্পের জন্য প্রয়োজন হবে ৪৩ হাজার ৭২৫ কোটি টাকার ঋণ। এছাড়া অন্যান্য খাতের মধ্যে সাধারণ সরকারি সেবা খাতের ১৩ প্রকল্পের জন্য ১৯ হাজার ২ কোটি টাকা, শিল্প ও অর্থনৈতিক সেবার ১৮ হাজার ৩ কোটি, কৃষির ১৯ প্রকল্পে ৯ হাজার ৩৫০ কোটি এবং স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন খাতের ১৬ প্রকল্পের জন্য দরকার ৪৪ হাজার কোটি টাকার ঋণ। আরও আছে স্বাস্থ্য খাতের ৭ প্রকল্পে ৬৬ হাজার ৭৪২ কোটি, ধর্ম ও সংস্কৃতির ৪ প্রকল্পে ৩৩৭ কোটি, শিক্ষার ১৬ প্রকল্পে ১০ হাজার ২১৬ কোটি, বিজ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তির ৮ প্রকল্পে ৭ হাজার ৮২ কোটি এবং সামাজিক সুরক্ষা খাতের ২ প্রকল্পের জন্য বৈদেশিক ঋণের প্রয়োজন ১৫৬ কোটি টাকা।
এই তালিকায় থাকা উল্লেখযোগ্য কয়েকটি প্রকল্প হলো- পঞ্চম স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর কর্মসূচি বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৭৫ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক ঋণের প্রত্যাশা হচ্ছে ৫৬ হাজার ৫৫৬ কোটি টাকা। ২০২৯ সালের জুনের মধ্যে এটি বাস্তবায়ন করতে চায় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। এছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৩ হাজার ১৫১ কোটি টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক ঋণের প্রয়োজন ৬১ হাজার ১৮৬ কোটি টাকা। ঋণ পেলে এটি চলতি অর্থবছর থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ সাউথ করিডর ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের (ফরিদপুর-বরিশাল এবং বরিশাল-কুয়াকাটা) ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৪ হাজার ৯১৯ কোটি ১৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক ঋণের প্রত্যাশা ২৮ হাজার ১১৯ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছর থেকে ২০৩০ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের সময় ধরা হয়েছে। ওয়াটার ফ্রন্ট স্মার্ট সিটি কেরানীগঞ্জ প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৮১ হাজার ৪৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক ঋণ ৫৪ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা। ২০৩৪ সালের জুনের মধ্যে এটি বাস্তবায়নের লক্ষ্য রয়েছে। এছাড়া তুরাগ নদের বন্যা প্রবাহ অঞ্চলের সংরক্ষণ এবং কমপ্যাক্ট টাউনশিপ ডেভেলপমেন্ট প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ৮৬ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক ঋণের লক্ষ্য ৪৫ হাজার ৯৬ কোটি টাকা। ২০৩৪ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন লক্ষ্য রয়েছে। ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (মেট্রোরেল লাইন-৫) এর মোট ব্যয় হবে ৫৪ হাজার ৬১৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক ঋণ ধরা হয়েছে ৩৯ হাজার ১৩৮ কোটি টাকা। ২০৩০ সালের মধ্যে এটি বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছে সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগ। আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রকল্প হলো, হাওর ফ্ল্যাড অ্যান্ড লাইভলিহুড প্রজেক্ট, জলবায়ু সহনশীল টেকসই জীবিকা প্রসার প্রকল্প, ভাঙ্গা-যশোর-বেনাপোল মহাসড়ক উন্নয়ন এবং ভাঙ্গা জয়শন (ফরিদপুর) হতে বরিশাল হয়ে পায়রাবন্দর ও কুয়াকাটা পর্যন্ত ব্রডগেজ রেলাইন নির্মাণ প্রকল্প।