কথা ছিল আনোয়ারা, বোয়ালখালী ও কর্ণফুলী- তিন উপজেলার ১০ হাজার আবাসিক গ্রাহক তো বটেই এখান থেকে পানি পাবে ছোট-বড় ১৩টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান। কিন্তু সে কথার আর বালাই নেই। দীর্ঘদিনেও চালু হয়নি প্রকল্পটি। গ্রাহকদের আগ্রহ কম এমন অজুহাত দেখাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।
‘চাহিদা নেই’ বলে সরবরাহ করা হচ্ছে না পানি
দৈনিক ছয় কোটি লিটার পানি সরবরাহের সক্ষমতা নিয়ে দক্ষিণ চট্টগ্রামে গড়ে তোলা হয়েছে ভান্ডালজুড়ি পানি শোধনাগার প্রকল্পটি। এক মাসের বেশি সময় ধরে চলছে শোধনাগারের কমিশনিং। কিন্তু কয়েক দফা সময় পরিবর্তনের পরেও প্রকল্পটি থেকে পানি সরবরাহ শুরুর সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না চট্টগ্রাম ওয়াসা। প্রাক্কলিত চাহিদা অনুযায়ী, গ্রাহক না পাওয়ায় প্রকল্পটি চালুর উদ্যোগ বারবার পিছিয়ে যাচ্ছে।
প্রকল্পের তথ্য অনুযায়ী, এ প্রকল্প থেকে ছোট-বড় মোট ১৩টি বাণিজ্যিক সংযোগের মাধ্যমে শিল্পাঞ্চলগুলোতে প্রতিদিন ৪ কোটি লিটার পানি সরবরাহের টার্গেট রয়েছে চট্টগ্রাম ওয়াসার। অন্যদিকে, এই প্রকল্পের পানির দুই কোটি লিটার আবাসিক গ্রাহকদের মধ্যে সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রকল্পের শুরুতেই দক্ষিণ চট্টগ্রামের দেশি-বিদেশি শিল্পজোন ও কারখানাগুলোর প্রায় সবগুলোই সুপেয় পানি নেওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছিল। প্রকল্পের কাজ শেষে চট্টগ্রাম ওয়াসা কর্তৃপক্ষ এসব শিল্পজোন ও কারখানা কর্তৃপক্ষকে পানির সংযোগ নেওয়ার জন্য চিঠি ইস্যু করে। কিন্তু এখন পর্যন্ত চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড (সিইউএফএল) ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠানই ইতিবাচক সাড়া দেয়নি। এ অবস্থায় গত জুন মাসে প্রকল্পটি চালু হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। কবে চালু হবে তাও বলতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা।
চট্টগ্রাম ওয়াসার কর্মকর্তারা বলছেন, ছয় মাস আগেও চায়না ইপিজেড কর্তৃপক্ষ চিঠি দিয়ে নিজেদের পানির চাহিদার কথা জানালেও এখন আর যোগাযোগ করছে না। এ প্রকল্পের প্রথম সংযোগ দেওয়ার কথা ছিল কর্ণফুলীর দক্ষিণ পাড়ের কোরিয়ান এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোনে। সেই উদ্যোগেও এখনো আগ্রহ দেখায়নি কোরিয়ান এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন।
মহাপরিকল্পনার পর কেটে গেছে ১৫ বছর
চট্টগ্রাম ওয়াসা সূত্র জানায়, ২০০৯ সালে কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় দাতা সংস্থা কোরিয়ান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (কোইকা) চট্টগ্রামের পানি ও পয়োনিষ্কাশন নিয়ে একটি মহাপরিকল্পনা তৈরি করে। ওই মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, চট্টগ্রামের দক্ষিণ অংশে পানি সরবরাহের উদ্যোগ নেয় ওয়াসা। কোরিয়ান এক্সিম ব্যাংক অর্থায়নের আগ্রহ দেখিয়ে প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করে। তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০৩১ সাল নাগাদ ওই অঞ্চলে পানির চাহিদা নির্ধারণ করা হয় দৈনিক ছয় কোটি লিটার।
প্রকল্পটির মেয়াদ ও অর্থ
চট্টগ্রাম ওয়াসার ভান্ডালজুড়ি পানি সরবরাহ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০১৫ সালের ২৬ নভেম্বর চট্টগ্রাম ওয়াসা এবং কোরিয়ান এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে ১ হাজার ৩৬ কোটি টাকার একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২০১৬ সালের ৫ জানুয়ারি একনেকে অনুমোদন পায় ওয়াসার ভান্ডালজুড়ি পানি শোধনাগার প্রকল্পটি। প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয় ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। তবে প্রকল্পের শুরুতে ভূমি নিয়ে জটিলতায় পড়তে হয় ওয়াসাকে। এজন্য তিন বছর আটকে পড়ে প্রকল্পটি। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে শুরু হয় নির্মাণকাজ। ২০২০ সালের ২৮ জানুয়ারি প্রথম সংশোধিত আকারে অনুমোদন পায় এটি। ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত সময় ও ব্যয় বৃদ্ধি পেয়ে এক হাজার ৯৯৫ কোটি ১৫ লাখ টাকায় দাঁড়ায়। প্রকল্প শুরুর পাঁচ বছর পর এসে প্রকল্পের মেয়াদ আরেক দফা বাড়িয়ে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়।
প্রকল্প চালু নিয়ে যা বলছেন সংশ্লিষ্টরা
ভান্ডালজুড়ি পানি সরবরাহ প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ মাহবুবুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রকল্পের কাজ শেষ। এখন ফ্লাসিং ও ডিজইনফেকশনের কাজ চলছে। তবে প্রকল্পের শুরুতে কোরিয়ান ইপিজেড, চায়না অর্থনৈতিক অঞ্চল, সিইউএফএল, ড্যাপ (ডাই অ্যামোনিয়াম ফসফেট কারখানা), কাফকো শিল্পাঞ্চল ও পটিয়া ইন্দ্রপোলের লবণ কারখানাগুলো পানির চাহিদার কথা জানিয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত সিইউএফএল ছাড়া আর কোনো প্রতিষ্ঠান পানির জন্য যোগাযোগ করেনি। অন্যদিকে, বোয়ালখালী, পটিয়া ও আনোয়ারা উপজেলার ১০ হাজার আবাসিক গ্রাহককে ভান্ডালজুড়ি পানি শোধনাগার প্রকল্প থেকে সংযোগ দেওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত মাত্র ৬৫০টি সংযোগ স্থাপন করা গেছে।
‘ওই তিন উপজেলার মানুষ ও কলকারখানাগুলো এখন গভীর নলকূপের পানি ব্যবহার করছে। যেহেতু আমরা পানি সরবরাহ শুরু করতে পারিনি, তাই আবাসিকে সংযোগ কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে বাড়েনি। এছাড়া স্থানীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোও গভীর নলকূপ থেকে পানি উত্তোলন করছে। এ কারণে তারাও এখন ওয়াসার পানির ব্যাপারে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। আশা করছি, পানি সরবরাহ শুরু হলে সংযোগের চাহিদাও বাড়বে।’ বলছিলেন প্রকৌশলী মাহবুবুল আলম
কোরিয়ান এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোনের উপ-মহাব্যবস্থাপক মুশফিকুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের নিজেদের অভ্যন্তরীণ সঞ্চালন লাইনগুলো এখনো প্রস্তুত নয়, তাই ওয়াসার পানির বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি। তবে সরবরাহ শুরু হলে আমরা পানি নেবো।’
চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম বলেন, ‘ওয়াসার ভান্ডালজুড়ি প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। আশা করছি এই সময়ের মধ্যে শিল্পকারখানা ও আবাসিকে সংযোগ স্থাপন সম্ভব হবে। পানি সরবরাহ শুরু করতে আমরা সব ধরনের চেষ্টা চালাচ্ছি।’
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে ওয়াসার প্রকল্পগুলো সঠিক সময়ে শেষ করা হয় না। নানা টালবাহানায় প্রকল্প ব্যয় বাড়ানো হয়। ভান্ডালজুড়ির ক্ষেত্রে চাহিদার আগেই সেবা তৈরি হয়ে আছে। প্রকল্পের পর প্রকল্প হাতে নেওয়ার আগে ভাবতে হবে প্রয়োজন কোথায় ও কতটুকু?’