তারা অভিযোগ করছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা এই কলেজগুলোতে প্রশাসনিক ও শিক্ষাগত ক্ষেত্রে নানা অস্বস্তি ও সংকট রয়েছে। শিক্ষার্থীরা এই দাবির সমর্থনে ‘বিশ্ববিদ্যালয় রূপান্তর কমিশন’ গঠনের আহ্বান জানিয়ে আন্দোলন করছে এবং বলেছেন, সরকার যদি তাদের দাবি না মানে, তবে তারা নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করবেন। যদিও সম্প্রতি সরকারের পক্ষ থেকে সাত কলেজের জন্য আলাদা প্রশাসনিক ব্যবস্থা তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, শিক্ষার্থীরা তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। ২০১৭ সালে যখন এই কলেজগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেওয়া হয়, তখনও অনেকেই এর বিপক্ষে ছিলেন। তবে, এখনকার আন্দোলনের মূল বিষয় হল, শিক্ষার্থীরা একটি স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাদের ভবিষ্যত নিশ্চিত করতে চাচ্ছেন, যা কতটা বাস্তবসম্মত হবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
শিক্ষার্থীদের দাবির নেপথ্যে
‘সাত কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় রূপান্তর টিম’-এর অন্যতম মুখপাত্র ও কবি নজরুল সরকারি কলেজে স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী জাকারিয়া বারী বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘দীর্ঘ সাত বছর ধরে আমরা শিক্ষা বৈষম্যের শিকার। অবকাঠামাগত কোনো সমস্যা নিয়ে আমরা শিক্ষকদের কাছে গেলে তারা আমাদের পাঠায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে তারা বলে, তোমাদের অভিভাবক আমরা না।’
তিনি বলেন, ‘আমরা পরিচয়হীনতায় ভুগছি। আমাদের অভিভাবক কে, আমরা জানি না।’
এটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বারী বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কোনো দাবিতে রাস্তায় নামলে খুব দ্রুত তাদের কর্তৃপক্ষ এসে তাদের সঙ্গে কথা বলে। তাদেরকে টেবিল টকে নিয়ে যায়। কিন্তু আমরা এতদিন আন্দোলন করার পরও আমাদেরকে কেউ টেবিল টকে নিয়ে আসেনি। কেউ আমাদের কাছে যায়নি, বলেনি যে তোমাদের সমস্যাটা কী।
তিনি আরও বলেন, ‘আমি যখন চাকরির ইন্টার্ভিউ দিতে যাই, তখন আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয় দিতে পারি না। কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমায় সেই অধিকার দেয় নাই। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয়ও দিতে পারি না, কারণ আমি ন্যাশনালেরও স্টুডেন্ট না। ‘
বারী বলেন, ‘চার বছর পড়াশুনার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের যে সার্টিফিকেট দিয়েছে, সেই সার্টিফিকেটে ভিন্ন ফন্টে এফিলিয়েটেড লেখা থাকে। চাকরির বাজারে এই শব্দটা আমায় পিছিয়ে দেয়। ‘
সংকট নতুন নয়
সাত কলেজ নিয়ে এই জটিলতার সূত্রপাত ২০১৭ সাল থেকে। সে বছর ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার সাতটি সরকারি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়।
কলেজগুলো হলো- ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, মিরপুরের সরকারি বাঙলা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজ। এর আগে কলেজগুলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ভুক্ত ছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করার কিছুদিন পর থেকে কলেজগুলো নিয়ে নানা ধরনের সমস্যা বিরাজ করছে। বিশেষ করে ২০১৮ সাল থেকে শিক্ষার্থীরা অনেক কিছুতে সংস্কারের দাবি জানিয়ে আসছে।
পরের বছর, ২০১৯ সালে আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত ওই সাতটি কলেজের অন্তর্ভুক্তি বাতিলের দাবিতে টানা বিক্ষোভ করে। তখন সাত কলেজের কিছু কিছু শিক্ষার্থীও দাবি করেছিলো, তারাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হতে চায়।
সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি বারী বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হতে চাওয়ার বিষয়টা এতদিন মন্তস্তাত্ত্বিক ছিল। এত বছর ধরে আমরা তো কেবল সংস্কার চেয়েছি। সংস্কারের জন্য নীলক্ষেত, সায়েন্সল্যাব, শাহবাগে আন্দোলন করেছি। গুলি খেয়েছি। এখন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়াতে আমরা স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় চাচ্ছি।’
এই সাতটি কলেজের শিক্ষা ও প্রশাসনিক সমস্যা নিরসনে গত ২৪ অক্টোবর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিবকে (কলেজ) সভাপতি করে ১৩ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু শিক্ষার্থীরা সেই কমিটিকে প্রত্যাখ্যান করেছে, তাদের সেই এক দাবি– কমিশন গঠন।
এর ব্যাখ্যায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলছেন, এরকম কমিটি ২০১৮ সালেও দেওয়া হয়েছিল। তখন সংস্কারের নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাদের সঙ্গে প্রহসন করেছে।
ছাত্র প্রতিনিধি, শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবীসহ সাত কলেজের অংশীজনদের নিয়ে কমিশন গঠন করার দাবি জানিয়ে আন্দোলকারী শিক্ষার্থীরা বলছে, কমিশন বিচার বিশ্লেষণ করবে, এই সাতটি কলেজের ভবিষ্যৎ কী হবে; সেই বিশ্ববিদ্যালয়টি দেখতে কী রকম হবে বা কীভাবে কাজ করবে।
কিন্তু কমিশন বিচার বিশ্লেষণ করে যদি দেখে যে বিশ্ববিদ্যালয় গঠন করা সম্ভব না, তাহলে তারা কমিশনের সিদ্ধান্ত মেনে নিবে কি না জানতে চাইলে বারী বলেন, ‘আমাদের চাওয়ায় যদি ভুল থাকে, জাতির উপকার না হয়ে যদি আমাদের শিক্ষা জীবনের ক্ষতি হয়, তাহলে এটা আমরা অবশ্যই করব না।’
তিনি বলেন, ‘আমরা সরকারকে এটা বলছি না যে আগামীকালই একটি বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা করে দিয়ে দেন। আমরা বলছি, আপাতত যেন সব পক্ষকে নিয়ে একটি কমিশন গঠন করা হয়।’
যদিও বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. এস এম এ ফায়েজ মনে করেন, কমিটি বা কমিশনে শাব্দিক পার্থক্য ছাড়া আর কোনো তফাৎ নেই।
তিনি বলেন, যে বিষয়ে তারা (শিক্ষার্থী) কমিশন গঠন করতে চাচ্ছে, সেই বিষয়টিই যদি কমিটি অ্যাড্রেস করতে পারে, তাহলেই তো হলো। সেটিকে আপনি কমিশন বলেন কিংবা কমিটি। আন্দোলনকে সামনে রেখেই তো তারা কাজ করছে…প্রয়োজনে তারা ছাত্রদের সাথে অবশ্যই আলাপ করবে।