র্ব ইউক্রেনের আকাশে হঠাৎ দেখা গেল সাদা ধোঁয়ার দুটি রেখা। ইউক্রেনীয়দের কাছে এর অর্থ একটাই রাশিয়ার দুইটি জেট বিমান হামলা করতে চলেছে। কিন্তু কোস্ত্যন্তিনিভকা শহরের কাছে যা ঘটেছিল তা ছিল নজিরবিহীন।
একটি ধোঁয়ার রেখা থেকে বের হলো একটি বস্তু। দ্রুতগতিতে সেটি এগিয়ে গেল আরেকটি রেখার দিকে। তারপর বিস্ফোরণে বিদ্যুৎ চমকের মতো আলোকিত হয়ে উঠল আকাশ। অর্থাৎ হয় রাশিয়ার কোনো যুদ্ধবিমান ভুলবশত আরেকটি যুদ্ধবিমানের ওপর হামলা চালিয়েছে। অথবা ইউক্রেনের যুদ্ধবিমানের হামলায় ধ্বংস হয়েছে রাশিয়ার কোনো যুদ্ধবিমান।
কৌতূহলী, ইউক্রেনীয়রা শীঘ্রই পতিত ধ্বংসাবশেষ থেকে জানতে পেরেছিল যে তারা এটি রাশিয়ার নতুন গোপন অস্ত্র ‘এস–৭০’। এটি একটি সামরিক ড্রোন। শত্রুপক্ষের রাডারে ধরা না পড়েই হামলা চালাতে পারে এটি। এই ড্রোনের আরেকটি নাম ‘ওখোতনিক’, অর্থ ‘শিকারি’।
ওখোতনিক ড্রোনগুলো যুদ্ধবিমানের মতো বড় আকৃতির। সেগুলোয় কোনো চালক থাকে না। আকাশে এই ড্রোন শনাক্ত করাও খুবই কঠিন। ওখোতনিকের নির্মাতাদের দাবি, বিশ্বে এই ড্রোনের তুলনা নেই বললেই চলে। তবে কস্তিয়ানতিনিভকার আকাশে যে ড্রোন ভিডিওতে ধরা পড়েছে, সেটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিল বলেই মনে হচ্ছে।
ভিডিওতে ড্রোনের ওপর যে আকাশযান দিয়ে হামলা চালাতে দেখা যায়, সেটি ছিল রাশিয়ার সু–৫৭ যুদ্ধবিমান। সেটি হয়তো ওই ড্রোনের সঙ্গে সংযোগ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছিল। শেষ পর্যন্ত সফল না হলে ড্রোনটি ধ্বংসের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কারণ, ড্রোনটি ইউক্রেনের আকাশে উড়ছিল। আর ধ্বংস না করা হলে সেটির প্রযুক্তি ইউক্রেনীয়দের হাতে চলে যাওয়ার ঝুঁকি ছিল।
সেদিন কস্তিয়ানতিনিভকার আকাশে আসলেই কী ঘটেছিল, সে সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করেনি মস্কো বা কিয়েভ। তবে ড্রোনটি যে আসলেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিল, তা মনে করেন সামরিক বিশ্লেষকদের অনেকে। তাদের বিশ্বাস, যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেন বাহিনীয় যে প্রযুক্তি ব্যবহার করছে, তার খপ্পরে পড়েই যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হয়েছিল ড্রোনটি।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে চলছে ইউক্রেন যুদ্ধ। এর পর থেকে দেশটির যুদ্ধক্ষেত্রে অনেক ধরনের ড্রোনের ব্যবহার হয়েছে। তবে সেগুলোর কোনোটিই এস–৭০–এর মতো নয়। এই ড্রোনের ওজন ২০ হাজার কেজির বেশি। হামলা চালাতে পারে ছয় হাজার কিলোমিটার এলাকাজুড়ে। এটি দেখতে অনেকটা তিরে মতো। ‘এক্স–৪৭বি’ নামের যুক্তরাষ্ট্রেরও প্রায় একই রকম দেখতে একটি ড্রোন রয়েছে।
ধারণা করা হয়, রাশিয়ার ওখোতনিক ড্রোনটি বোমা ও রকেট বহন করতে পারে। সেগুলো দিয়ে হামলা চালাতে পারে স্থল ও আকাশের কোনো লক্ষ্যবস্তুতে। নজরদারির কাজেও ব্যবহার করা যায় ড্রোনটি। উল্লেখযোগ্য আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, রাশিয়ার পঞ্চম প্রজন্মের সু–৫৭ যুদ্ধবিমানের সঙ্গে মিলে হামলা চালাতে পারে ওখোতনিক।
২০১২ সাল থেকে ওখোতনিক নিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল রাশিয়া। ২০১৯ সালে প্রথমবারের মতো এটি আকাশে ওড়ানো হয়। তবে সেটি যে ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে, তা কয়েক দিন আগেও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। চলতি বছরের শুরুর দিকে ড্রোনটি দক্ষিণ রাশিয়ার আখতুবিনস্ক বিমানঘাঁটিতে দেখা মেলা খবর পাওয়া যায়। এই ঘাঁটি ইউক্রেনে হামলা চালানোর জন্য ব্যবহার করা হয়।
রাশিয়ার কাছে মোট চারটি ওখোতনিক ড্রোন আছে বলে মনে করা হয়। এর একটিই সম্প্রতি ইউক্রেনে ধ্বংস হলো। এ ব্যর্থতা মস্কোর জন্য অবশ্যই বড় একটি ধাক্কা। কারণ, চলতি বছরেই সেটির পুরোপুরি উৎপাদন শুরু করার কথা রয়েছে। তবে সাম্প্রতিক ব্যর্থতা থেকে বোঝা যাচ্ছে, ড্রোনটি এখনো ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত নয়।
ইউক্রেনে ভূপাতিত হওয়ার আগে ওখোতনিক ড্রোনটি ধ্বংস করা হলেও সেটি থেকে এখনো ইউক্রেনীয়রা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেতে পারেন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকদের অনেকে। কিয়েভভিত্তিক উড়োজাহাজ বিশেষজ্ঞ আনাতোলি খ্রাপচিনস্কি বলেন, লক্ষ্যবস্তু খুঁজে বের করার জন্য ড্রোনটির নিজস্ব রাডার আছে কি না বা এমন অনেক তথ্য এখনো ধ্বংসাবশেষ থেকে জানা যেতে পারে।
ওখোতনিক যেখানে ভূপাতিত হয়েছিল, সেখানকার ছবি খতিয়ে দেখেছেন আনাতোলি। তাঁর মতে, ড্রোনটির রাডারকে ফাঁকি দেওয়ার সক্ষমতা সীমিত। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ড্রোনটির ইঞ্জিনের পেছনের অংশ (নজল) গোলাকৃতির। এটি সহজেই রাডারে ধরা পড়তে পারে। আর সেটির কিছু সরঞ্জাম অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি বলে মনে হয়েছে। এটিও রাডার ফাঁকি দিতে সক্ষম নয়।
এটা নিশ্চিত যে ড্রোনটির ধ্বংসাবশেষ এখন খতিয়ে দেখবেন ইউক্রেনের প্রকৌশলীরা। তাঁদের পাওয়া তথ্যগুলো কিয়েভের পশ্চিমা মিত্রদের হাতে তুলে দেওয়া হবে। তবে এটাও ঠিক যে রাশিয়া বসে নেই। নতুন ও আরও আধুনিক উপায়ে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে কাজ করছে মস্কো। আর আজ তারা ব্যর্থ হয়েছে, তার অর্থ এই নয় যে কাল সফল হবে না।