পাসপোর্ট অফিসের দালালের সহকারী থেকে সম্পদের পাহাড়

পাসপোর্ট অফিসের দালালের সহকারী থেকে সম্পদের পাহাড়

কুমিল্লা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের দালালের সহকারী ছিলেন মো. কামাল হোসেন। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে তিনি এখন শত শত কোটি টাকার মালিক। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী তাজুল ইসলামের সান্নিধ্যে এসে যেন আলাদিনের চেরাগ হাতে পেয়েছেন তাঁর কথিত উন্নয়ন সমন্বয়কারী ও ব্যক্তিগত সহকারী (পিএস) পরিচয় দেওয়া মো. কামাল হোসেন। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, জমি দখল, সালিশ বৈঠক, ঠিকাদারি কাজে অনিয়ম, থানায় তদবিরসহ নানা  দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর কৌশলে আত্মগোপনে চলে যান কামাল। একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছেন, তিনি দুবাইয়ে রয়েছেন। জানা যায়, কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ উপজেলার লক্ষণপুর গ্রামের কৃষক নূর মোহাম্মদের ছেলে কামাল হোসেন কুমিল্লা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে এক দালালের সহকারী হিসেবে কাজ করতেন। প্রায় ১১ বছর আগে কুমিল্লার তৎকালীন সংসদ সদস্য তাজুল ইসলামের সঙ্গে পরিচয়ের মাধ্যমে তাঁর ভাগ্যের চাকা বদলে যেতে থাকে। ২০১৮ সালে তাজুল ইসলাম স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রীর দায়িত্ব পেলে তাঁকে মন্ত্রীর উন্নয়ন সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয় বলে কামাল প্রচার করতে থাকেন। কামাল কুমিল্লা এলজিইডি অফিসের টেন্ডারবাজির নিয়ন্ত্রণ, ঠিকাদারি, মন্ত্রীর কমিশন বাণিজ্য এবং অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে ফুলে-ফেঁপে উঠতে থাকেন। মাস্টার এন্টারপ্রাইজ নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে লাকসাম-মনোহরগঞ্জ এলজিইডির বেশির ভাগ ঠিকাদারি বাগিয়ে নিতেন। কোটি কোটি টাকার কাজ কমিশন নিয়ে সাব কন্ট্রাক্টে দিতেন। তাঁর বিরুদ্ধে ৯ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০২৩ সালের ২৩ নভেম্বর দুদক কুমিল্লার সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক পাপন কুমার সাহা বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। দুদকের অনুসন্ধানে তাঁর নিজ নামে স্থাবর ও অস্থাবর মিলিয়ে ১৫ কোটি ১৭ লাখ ৮৯ হাজার ২৫৫ টাকার সম্পদের তথ্য পাওয়া যায়। দুদকসূত্র জানান, তাঁর পারিবারিক ব্যয়, পরিশোধিত কর, অপরিশোধিত দায়সহ ১৭ কোটি ১৩ লাখ ৯৯ হাজার ২৬ টাকার নিট সম্পদ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৮ কোটি ২০ লাখ ২১ হাজার ৮০ টাকার সম্পদের বৈধ উৎস পাওয়া গেছে। আর ৮ কোটি ৯৩ লাখ ৭৭ হাজার ৯৪৬ টাকার সম্পদের কোনো বৈধ উৎস পাওয়া যায়নি। এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, কুমিল্লার আদর্শ উপজেলায় তাঁর নামে ১০ তলায় দুটি ফ্লোর ও ছয় তলা ভবন, কুমিল্লা সদরসহ বিভিন্ন জায়গায় ৫০০ শতক জমি, টয়োটা হ্যারিয়ার গাড়ি এবং ব্যাংকে গচ্ছিত ৮ কোটি টাকার বেশি সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। তবে স্থানীয়রা বলছেন, কামালের বিপুল সম্পদের সিকিভাগও দুদকের তদন্তে আসেনি। তাঁর কুমিল্লার হাউজিং এস্টেটে একাধিক বাড়ি, কান্দিরপাড় এলাকায় বিগ বাজার সুপার মার্কেট, একই এলাকায় অনেক ফ্ল্যাট, ঢাকায় ফ্ল্যাট ও প্লট এবং কৃষি ও অকৃষি জমির তথ্য বের করতে পারেনি দুদক। স্থানীয়রা জানান, শুধু কুমিল্লা শহরেই কামালের ২০০ থেকে ৩০০ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। তাঁর মোট সম্পদের পরিমাণ ৬০০ কোটি টাকার বেশি। তারা তাঁর এসব অবৈধ সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার দাবি জানিয়েছেন।

দুদক কুমিল্লার উপপরিচালক ফজলুর রহমান বলেন, ‘ঠিকাদার কামাল হোসেনের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাঁর বিষয়ে তদন্ত অব্যাহত আছে। এ বিষয়ে অভিযুক্ত কামাল হোসেনের বক্তব্য নেওয়ার চেষ্টা করা হলেও আত্মগোপনে থাকায় তা সম্ভব হয়নি। তাঁর ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটিও বন্ধ রয়েছে। এদিকে ৫ আগস্ট দেশের পট পরিবর্তনের পর কামাল কৌশলে দুবাই পাড়ি জমিয়েছেন। একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল ছিল কামালের নিয়ন্ত্রণে : শুধু এলজিইডি নয়, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিপ্তরের (ডিপিএইচই) কুমিল্লা শাখাও ছিল কামালের নিয়ন্ত্রণে। মো. তাজুল ইসলাম এলজিআরডি মন্ত্রী থাকাকালে সাড়ে পাঁচ বছর শুধু কুমিল্লায় ডিপিএইচইয়ের হাজার কোটি টাকার কাজ হয়েছে। প্রতিটি কাজের ঠিকাদার নিয়োগ দিতেন কামাল। প্রতিটি কাজ থেকে ১০% কমিশন নিতেন। আর এর সহযোগী ছিলেন ডিপিএইচই কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ নাসরুল্লাহ। তিনিও নামে-বেনামে প্লট, ফ্ল্যাটসহ কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যান। অভিযোগ রয়েছে, ২০২২ সালের ২৬ জুলাই কার্যাদেশ দেওয়া কাজ মাত্র চার দিনে অর্থাৎ ৩০ জুলাই শেষ হয়ে যায়। আড়াই কোটি টাকার এ কাজ সম্পন্ন ও চূড়ান্ত বিল প্রদানের মতো হরিলুট করেছেন এ কর্মকর্তা ও মন্ত্রীর সহচর কামাল। জানা গেছে, প্রকল্পটি ছিল ২০২১-২২ অর্থবছরে পল্লী অঞ্চলে পানি সরবরাহের। এ কাজের দরপত্র আইডি-৭০৮৬৪২, প্যাকেজ নম্বর ছিল ভিডব্লিউএসপি-১৯৯৮/৫। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী কার্যাদেশ প্রদানের চার দিনের মাথায় কোনোরূপ কাজ সম্পাদন না করে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান মেসার্স রুদ্র কনস্ট্রাকশনের নামে চূড়ান্ত বিল প্রদান করা হয়। যে টাকা তিনি আত্মসাৎ করেছেন। ওই প্রকল্পের প্যাকেজে ১০০ গভীর নলকূপ ও ১০০ আয়রন রিমুভাল প্লান্ট স্থাপনকাজে কমপক্ষে ছয় মাস সময়ের প্রয়োজন। সেখানে মাত্র চার দিনে কাজ সম্পন্ন ও চূড়ান্ত বিল প্রদান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এ ছাড়া তিনি ঠিকাদারদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলামের নাম ভাঙিয়ে কার্যাদেশের ১০ শতাংশ টাকা গ্রহণ করতেন। জানা গেছে, সারা দেশে ১০ শতাংশ লেসে কাজ হয়। কিন্তু মন্ত্রীর পিএস কামাল হোসেন প্রভাব খাটিয়ে ওই কাজ ১০ শতাংশ ঊর্ধ্বদরে পাস করিয়ে নিতেন।