সাধারণ অর্থনৈতিক তত্ত্ব বলছে—দুর্নীতি বিনিয়োগের গতি কমিয়ে দিয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হ্রাস করে ও পণ্য মূল্যকে প্রভাবিত করে। ফলে, অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি দেখা দেয় এবং সর্বোপরি দুর্নীতি সুশাসনকেও বাধাগ্রস্ত করে। আর, সরকারি কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ওপর একটি দেশের সুশাসন নির্ভর করে। তবে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জন, মূল্যস্ফীতি কমানো ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি সম্ভব। কিন্তু, আমাদের অর্থনীতিতে তা কখনোই দৃশ্যমান হয়নি।
অর্থনীতিতে উপরোক্ত ইতিবাচক সূচকগুলো দৃশ্যমান না হওয়ার অর্থই হচ্ছে আমরা সমাজে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারিনি। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সুশাসনের অভাবে দেশ অর্থনীতির বিদ্যমান সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে ব্যর্থ হচ্ছে বারবার। কেননা, আমরা প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক উভয় ক্ষেত্রেই দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরে রাখতে পারিনি।
যার ফলে, আমরা কোভিড-১৯ পরবর্তী কয়েকটা বছর যাবৎ অনেকগুলো চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছি। যেমন মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, মুদ্রা পাচার, বৈদেশিক মুদ্রা মজুত পতন, রেমিট্যান্স প্রবাহ হ্রাস, আন্তর্জাতিক লেনদেনে অস্থিতিশীলতা, ক্রেডিট রেটিং-এ অবনমন, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি, দেশি-বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধের চাপ ইত্যাদি।
একটি উদীয়মান অর্থনীতিতে বিভিন্ন কারণে এ ধরনের নেতিবাচক সূচকের উপস্থিতি স্বল্পমেয়াদে থাকতেই পারে। তবে সরকারের দূরদৃষ্টি, সঠিক কর্মপন্থা, পরিচালন দক্ষতা, সম্পদ ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জনগণের সম্পৃক্ততায় তা দূর করাও সম্ভব। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এগুলোর অবস্থান একটি সবল অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
বর্তমান পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, এটা স্বীকার করতে বাধা নেই যে, পূর্বের সরকারের সময়োপযোগী সঠিক সিদ্ধান্তের ফলে বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ মহামারির পরেও আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল বেশ ঈর্ষান্বিত। বাংলাদেশ ব্যাংকের মতে, দেশের প্রকৃত জিডিপি বৃদ্ধির হার ছিল ২০২১ সালে ৬.৯৪ শতাংশ এবং ২০২২ সালে ৭.১০ শতাংশ। কিন্তু এরপর থেকেই প্রবৃদ্ধিতে ধীরগতি চলে আসে যা ২০২৩ সালে দাঁড়ায় ৫.৭৮ শতাংশ
বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রথমত কোভিড-১৯ মহামারি; দ্বিতীয়ত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও তৎপরবর্তী ইসরায়েল-ফিলিস্তিন চলমান যুদ্ধের ফলে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় দ্রব্যের দাম বৃদ্ধির পর আমদানিতে ডলারের দাম বাড়ে। এর ফলে আমদানি মূল্য দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং রপ্তানি মূল্য মন্থর থাকে।
ফলশ্রুতিতে, অর্থপ্রদানের ভারসাম্যের অবনতির কারণে বৈদেশিক মুদ্রা মজুত ব্যাপক হ্রাস পায় ও টাকার অবমূল্যায়ন ঘটে। দীর্ঘদিন ১১০ টাকায় থাকা ডলারের অফিশিয়াল রেট ২০২৪ সালের মে মাসে একদিনে ১১৭ টাকায় উন্নীত হয় এবং পরবর্তীতে আরও বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে মানি এক্সচেঞ্জররা খোলা বাজারে ১২৫ টাকায় ডলার বিক্রি করছে। এর পেছনে বৈশ্বিক আর্থিক অস্থিরতা প্রধানত দায়ী থাকলেও আমাদের দুর্নীতিও কোনো অংশে কম দায়ী নয়।
আমাদের দেশে দুর্নীতির অর্থ মুষ্টিমেয় গোষ্ঠী বা ব্যক্তির কাছে পুঞ্জীভূত হচ্ছে। আর, পুঞ্জিভূত অর্থই বৈদেশিক মুদ্রায় অবৈধ উপায়ে পাচার হচ্ছে বিদেশে এবং বিভিন্ন উপায়ে অর্থ পাচার চলছে। ফলশ্রুতিতে, বৈদেশিক মুদ্রা মজুতে টান পড়েছে এবং আমাদের ক্রয় ক্ষমতা সংকুচিত হচ্ছে। ফলে, ডলারের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে হু হু করে দিনের পর দিন। আইএমএফ থেকে শর্তসাপেক্ষে ঋণ নিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা মজুদের হ্রাস ঠেকানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
ডলারের মূল্য বৃদ্ধির সাথে সাথে আমাদের দেশে পণ্য সামগ্রীর দামও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। বছরজুড়েই মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশে ছুঁইছুঁই করছে। সর্বশেষ ২০২৪ সালের জুনে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যে মূল্যস্ফীতির হার ৯.৭২ শতাংশে ও খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ১০.৪২ শতাংশে দেখানো হয়েছে
দেশে খাদ্যপণ্যের কোনো সংকট না থাকলেও সব নিত্যপণ্যের দামই কেন এত বেশি! এর পেছনেও রয়েছে দুর্নীতি। দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধিতে সক্রিয় বাজার সিন্ডিকেট। অতি মুনাফার জন্য অনৈতিক ও বেআইনিভাবে দাম বাড়িয়ে মানুষের পকেট কাটা হচ্ছে যা স্পষ্টতই অপরাধ।
দুর্নীতি শুধু বাজার ব্যবস্থায় নয়; শেয়ার ও ডলারের মূল্যে কারসাজি, খেলাপি ঋণ, উন্নয়ন প্রকল্প, অফিস-আদালতে ফাইল প্রসেসিং, ভূমি-নদী-খাল-বিল দখল, টেন্ডার ও নিয়োগ প্রক্রিয়াতেও দুর্নীতির সরব উপস্থিতি। শিক্ষা থেকে রাজনৈতিক ব্যবস্থা, ব্যক্তি থেকে প্রতিষ্ঠান, মাঠ থেকে নীতিনির্ধারণী পর্যায়, পিয়ন বা ড্রাইভার থেকে উচ্চতর কর্মকর্তা পর্যন্ত সব ক্ষেত্রেই বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে বড় বড় দুর্নীতির খবর বেরিয়ে আসছে প্রতিনিয়ত।
তবে এটাও সত্যি যে, এতকিছুর মাঝেও আমাদের দেশে এক দশকে ভৌত অবকাঠামোর অনেক উন্নয়ন হয়েছে। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেস হাইওয়ে, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, কর্ণফুলী টানেল, আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দর, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, আরও অনেক সেতু, রাস্তাঘাট, প্রভৃতি। আমরা অনুন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছি। আর এর সুফলও আমরা পাচ্ছি। কিন্তু দুর্নীতি সব কৃতিত্ব ম্লান করে দিচ্ছে।
কেননা, দুর্নীতি সম্পর্কে আমাদের সমাজে দৃষ্টিভঙ্গি এরকম যে নিজে দুর্নীতি করলে সমস্যা নেই। কেননা, তার অনেক কারণ আছে। কিন্তু অন্যের দুর্নীতি কখনোই সহ্য করতে পারি না। আর ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতি তো মেনে নেওয়া দুরূহ। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর ভাষায় ‘আমরা সবাই পাপী; আপন পাপের বাটখারা দিয়ে অন্যের পাপ মাপি।’
তবে দৃষ্টিভঙ্গি যাই হোক না কেন, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থানের অবনতি হয়েছে। এবার বাংলাদেশের অবস্থান হয়েছে ১০তম, যা গতবার ছিল ১২তম। জার্মানির বার্লিনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) দুর্নীতির ধারণাসূচক প্রতিবেদন ২০২৩-এ এমন চিত্র উঠে এসেছে।
এর ফলে, পূর্বের সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে ঘোষিত ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা’-এর কার্যক্রম দৃশ্যমান হয়নি। উপরন্তু, দুর্নীতির ব্যাপকতা ঘনীভূত ও বিস্তৃত হয়েছে। স্মার্ট বাংলাদেশে স্মার্ট দুর্নীতিরও আবির্ভাব ঘটেছে। রাহুর মতো গ্রাস করছে অর্থনীতিকে। আর, দুর্নীতির দুষ্ট চক্রে খাবি খাচ্ছে অর্থনীতি।
তাছাড়া, দুর্নীতি ছাড়াও স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতাশীল রাজনৈতিক দৌরাত্ম্যের কারণে উন্নয়ন কার্যক্রমে সরকারকে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। একদিকে যেমন সরকারকে অতিরিক্ত অর্থ পরিশোধের চাপ সামলাতে হচ্ছে, আবার অন্যদিকে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিচ্ছে।
দুর্নীতির কারণে রাজস্ব আদায়েও ঘাটতি হয়। এই ঘাটতি মেটাতে পরিচালনা ব্যয়ে সরকারকে বাধ্য হয়ে দেশি-বিদেশি উৎস থেকে ঋণ করতে হয়। সরকারি ঋণ ও খেলাপি ঋণ উভয়ের বৃদ্ধির কারণে ব্যাংকের তারল্য কমে যায়। টাকা ছাপিয়েও এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হলেও সম্পূর্ণরূপে তার সমাধান হয় না। আর অতিরিক্ত অর্থ সরবরাহ মূল্যস্ফীতিতে অতিরিক্ত মাত্রা যোগ করে।