লতিফ সিদ্দিকী ছাড়া আত্মগোপনে দুই প্রতিমন্ত্রী ও পাঁচ সংসদ সদস্যসহ টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনগুলোর শীর্ষ নেতারা। এছাড়াও আত্মগোপনে রয়েছেন উপজেলা চেয়ারম্যান ও পৌর মেয়রসহ বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও দলীয় শীর্ষ পদধারীরাও।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের পরই এলাকা ছাড়তে শুরু করেন নেতারা। বর্তমানে তাদের সম্পর্কে কেউ কোনো তথ্যও দিতে পারছেন না। অনেকেই আত্মরক্ষার্থে ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন। এতে চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা। সংকটময় এই মুহূর্তে বাড়িঘরে হামলা-ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের আশঙ্কায় রয়েছেন তারা।
সর্বশেষ দ্বাদশ জাতীয় সংসদে টাঙ্গাইল জেলার সংসদীয় আটটি আসনের পাঁচটিতেই সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগ নেতারা। তিনটিতে জয় পান স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। চলমান এই পরিস্থিতিতে সাবেক বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু, সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী শামছুন্নাহার চাপা, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক সংসদ সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক, সাবেক সংসদ সদস্য তানভীর হাসান ছোট মনির, সাবেক সংসদ সদস্য হাছান ইমাম খান সোহেল হাজারী, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জোয়াহেরুল ইসলাম ভিপি জোয়াহেরসহ জেলা-উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত আমানুর রহমান খান রানার বাড়িঘরেও ভাঙচুর চালানো হয়েছে।
অপরদিকে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য ছানোয়ার হোসেনের বাড়ি ভাঙচুর না করা হলেও তিনিসহ আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক এমপি-প্রতিমন্ত্রীসহ বিভিন্ন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়র, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা-উপজেলার নেতাকর্মীরা বাড়িঘর ছেড়ে আত্মগোপনে চলে গেছেন।
তবে আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য, সাবেক মন্ত্রী ও সাবেক (স্বতন্ত্র) সংসদ সদস্য আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে সমর্থন করায় বহাল তবিয়তে রয়েছেন।
জানা যায়, সারাদেশের মতো টাঙ্গাইলেও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন কর্মসূচি পালন করে ছাত্র-জনতা। গত ৪ আগস্ট টাঙ্গাইল শহরে ওই আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা ও গুলিবর্ষণের পর উত্তপ্ত হয়ে ওঠে টাঙ্গাইলের পরিবেশ। এতে গুলিবিদ্ধসহ অর্ধশত আহত হন। এরপরই ক্ষুব্ধ আন্দোলনকারীরা সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জোয়াহেরুল ইসলাম জোয়াহেরের গাড়িতে আগুন ও বাড়িতে ভাঙচুর করে। এরপর আন্দোলনকারীরা জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য তানভীর হাসান ছোট মনিরের শহরের পূর্ব আদালত পাড়ার বাসায় হামলা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। পরে ঢাকা-টাঙ্গাইল ও বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কে টাঙ্গাইল শহর বাইপাস দরুণ এলাকায় সাবেক এমপি ছোট মনিরের মালিকানাধীন দি টাঙ্গাইল ফিলিং স্টেশন ও ধ্রুব ইন রেস্তোরাঁতেও ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করে। ওইদিন টাঙ্গাইল পৌরসভার মেয়র ও শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি এসএম সিরাজুল ইসলাম আলমগীরের বাসা ও পৌরসভায় ভাঙচুর করে আগুন দেওয়া হয়।
এছাড়া জেলা আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ কার্যালয় ভাঙচুর ও আসবাবপত্রে আগুন দেওয়া হয় এবং সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান তোফাজ্জল হোসেন তোফার বাসায় ভাঙচুর ও আগুন দেওয়া হয়।
গত ৩ আগস্ট সার্কিট হাউজে জেলা আওয়ামী লীগের আয়োজনে বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে ৪ আগস্ট আন্দোলনকারীদের প্রতিহত করার বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান খান ফারুক, সাধারণ সম্পাদক জোয়াহেরুল ইসলাম, সহ-সভাপতি আশরাফুজ্জামান স্মৃতি, সহসভাপতি ও সাবেক (স্বতন্ত্র) এমপি ছানোয়ার হোসেন, যুগ্ম-সম্পাদক ও সাবেক এমপি তানভীর হাসান ছোট মনির, জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক এমপি খান আহম্মেদ শুভ, সাংগঠনিক সম্পাদক জামিনুল রহমান মিরন ও সাইফুজ্জামান সোহেল, কেন্দ্রীয় যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যাডভোকেট মামুনুর রশীদ, টাঙ্গাইল পৌর মেয়র এসএম সিরাজুল হক আলমগীর, সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান তোফাজ্জল হোসেন খান তোফাসহ জেলার নেতারা। তবে আগের দিন বিকেলে আলোচনা হলেও পরেরদিন আর তাদের মাঠে দেখা যায়নি। ৫ আগস্ট দুপুরে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশত্যাগের পর এমপি ও নেতাকর্মীরা এলাকাছাড়া হয়ে যান। এরপর তারা কে কোথায় আছেন, কেউ কোনো খোঁজ খবর জানে না।
আওয়ামী লীগের একাধিক নেতাকর্মী জানান, দলীয় প্রতিমন্ত্রী-এমপি ও জেলার নেতারা কে কোথায় আছেন তা কেউ জানেন না। কারো সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। শুধু জেলার নেতারাই নয়, উপজেলা বা ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতারাও হামলার ভয়ে এলাকা ছেড়ে আত্মগোপনে চলে গেছেন। তবে এখনও তাদের মধ্যে অনেকেই বিদেশে যেতে না পেরে দেশেই আত্মগোপনে রয়েছেন। সুবিধামতো সময়ে অনেকে হয়তো বিদেশে পাড়ি জমাতে পারেন।
ফতেপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুর রউফ বলেন, বুধবার (৭ আগস্ট) একদল দুষ্কৃতকারী আওয়ামী লীগ অফিসে হামলা চালায় এবং আসবাবপত্র পুড়িয়ে দেয়। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে ধাওয়া পাল্টাধাওয়া হয়। বৃহস্পতিবার সকালে দুষ্কৃতকারীরা ইউপি কার্যালয়ের সামনে এসে গালিগালাজ করতে থাকে। বিষয়টি সেনা সদস্যদের জানানো হলে তারা ঘটনাস্থলে আসেন। সেনা সদস্যদের উপস্থিতি টের পেয়ে দুষ্কৃতকারীরা চলে যান। সেনা সদস্য চলে যাওয়ার পর দুষ্কৃতকারীরা আবার এসে হুমকি ধামকি দিতে থাকেন। এ কারণে পরে তিনি আত্মগোপনে চলে যান।