স্বাধীনতার অগ্রদূত, মহানায়ক, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আজ ১০৪ তম জন্মবার্ষিকী। তাঁর এই জন্মদিনে স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই। বঙ্গবন্ধু শুধু একটি নাম নয়, একটি ইতিহাস। এই মহানায়কের জন্ম না হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। বাঙালি জাতির লালিত স্বপ্ন মহান স্বাধীনতা ও মহান বিজয়ে তাঁর অবদান প্রত্যক্ষ এবং স্পষ্ট। স্বায়ত্তশাসন, স্বাধীনতা ও সংসদীয় গণতন্ত্রের স্বপ্নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা বাংলাদেশকে চূড়ান্ত স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।
বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে হয়তো এই জনপদের ইতিহাস ভিন্ন হতো; পরাধীনতা, দাসত্ব ও দুঃসহ দারিদ্র্যের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে থাকত এই জনপদের মানুষের ভাগ্যলিপি। তিনি সব সময় জাতির কল্যাণচিন্তায় মগ্ন থাকতেন। তাঁর ছিল অসাধারণ সংকল্প, সাহস ও স্বপ্ন। জাতির ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য তিনি সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেন। জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য সময় কাটান কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। নিগৃহীত হন নানাভাবে। মৃত্যুর মুখোমুখিও হতে হয় একাধিকবার। কিন্তু কখনো দেশের দুঃখ-দুর্দশাপীড়িত মানুষের মুখে হাসি ফোটাবার সংকল্প হতে চ্যুত হননি বিন্দুমাত্র।
শেখ মুজিবুর রহমানের ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়ে ওঠার পেছনের রাজনৈতিক ইতিহাস দেখলেই বোঝা যায়, কেন তিনি বাংলার অবিসংবাদিত নেতা, কেন তিনি জাতির পিতা। বাল্যকাল থেকেই তিনি যে রাজনৈতিক দীক্ষায় দীক্ষিত হন, সেটি সব সময় ছিল মানুষের পক্ষে। তিনি স্বপ্ন দেখতেন মানবমুক্তি আর শোষণহীন সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠার। তাঁর চিন্তাজগতের অপরিহার্য ছিল, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে (বর্তমান বাংলাদেশ) পাকিস্তানি শোষণ থেকে মুক্তি। বঙ্গবন্ধুর এই মুক্তির আন্দোলনের শুরু হয় ১৯৪৭ সালের পর থেকেই, যদিও চূড়ান্ত রূপটি আসে আরও পরে। সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগের পর থেকেই এক নতুন অধ্যায়ের পথে যাত্রা শুরু করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ। কেননা, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলেও বাঙালি তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার লাভ করতে পারেনি, পাকিস্তানি শাসকদের বিরামহীন বঞ্চনার শিকারে পরিণত হয় বাংলার কোটি কোটি জনতা।
ভাষা আন্দোলন এবং চুয়ান্ন সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন বাঙালিদের সাময়িক সুযোগ সৃষ্টি করে দিলেও পাকিস্তানি শাসকদের নগ্ন অপরাজনৈতিক খেলার দাবার ঘুঁটির চাল থেকে তখনো মুক্ত হতে পারেনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান। জনগণের রায়কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সামরিক জান্তা আইয়ুব খানের ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে পুরো পাকিস্তানের রাজনীতির অঙ্গনে এক নতুন মাত্রা রূপ পায়, যা কি না বাঙালির অত্যাচারের স্টিম রোলারকে আরো বেশি বেগবান করে। ভাষা আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসনের ছয় দফা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুকে কারাগারে রেখে বিচার, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে কারামুক্তি, রেসকোর্সের ময়দানে ছাত্র-জনতার আয়োজিত সংবর্ধনা সভায় বঙ্গবন্ধু উপাধি প্রদান, ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে অভূতপূর্ব বিজয়, ২ মার্চ অসহযোগ আন্দোলনের ডাক, ৭ মার্চের ভাষণে কার্যত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা, সেদিন থেকে ২৫ মার্চের কালরাত পর্যন্ত বাংলাদেশ কাঁপানো ১৮ দিনে ৭ মার্চের দিকনির্দেশনায় বাঙালি জাতিকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করা এবং এক গভীর প্রজ্ঞায় ও অনমনীয় দৃঢ়তায় জীবনের পরোয়া না করে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর হাতে কারাবরণ; তারই ফলে বঙ্গবন্ধুর নামে নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে অকাতরে মানুষের জীবনদান, স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্বজনমত গড়ে ওঠা এবং ৯৩ হাজার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর আবাল্য-লালিত স্বপ্ন স্বাধীন বাংলাদেশ মুক্তিলাভ করল। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ বাঙালি জাতিকে দারুণভাবে আন্দোলিত করে। তাঁর ভাষণে যুদ্ধের প্রস্তুতির সুস্পষ্ট নির্দেশ ছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে, তা-ই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।’ সেদিনের ভাষণে আরো সুস্পষ্ট ঘোষণা ছিল, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে যে দেশটি আজ প্রতিষ্ঠিত, তার অবয়ব তৈরির কাজটি করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা ঢাকাসহ সারা দেশে গণ হত্যা শুরু করলে বঙ্গবন্ধু ২৫ মার্চ দিবাগত রাত ১২.২০ মিনিটে, অর্থাৎ ২৬ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন। ঘোষণাটি নিম্নরূপ :