পবিত্র রমজানের আগমনে সাহাবিদের হৃদয়ে হৃদয়ে, ঘরে ঘরে খুশি ও আনন্দের বন্যা বয়ে যেত। তাদের উৎসাহ ও উদ্দীপনামুখর প্রস্তুতি দেখলে যে কেউ বলে দিতে পারতেন, রমজান সমাগত। অন্যান্য সব ব্যস্ততা থেকে অবসর হয়ে রমজানের প্রতীক্ষায় প্রহর গুনতেন তারা। পরিবারের শিশু থেকে বৃদ্ধ, সব বয়সের সদস্যকে রমজানের সৌভাগ্য অর্জনের উদ্যোগ গ্রহণ করতেন। উৎসবের আমেজ বিরাজ করত প্রতিটি ঘরে। সাহাবায়ে কেরামের (রা.) রমজানের প্রস্তুতি সম্পর্কে অনেক আমলের বর্ণনা পাওয়া যায়।
বিশেষ দোয়া : সাহাবায়ে কেরাম (রা.) রোজার প্রস্তুতি গ্রহণ করতে সীমাহীন আগ্রহী ছিলেন। রমজান মাস প্রাপ্তির লক্ষ্যে আল্লাহ তায়ালার দরবারে দোয়া ও মোনাজাতের মাধ্যমে কান্নাকাটি করতেন। ছয় মাস দোয়ায় কাটিয়ে দিতেন আর ছয় মাস রোজা, ইবাদত, আনুগত্যের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করতেন। কেমন যেন পুরো বছরই তাদের রোজার মাস ছিল! হজরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.) দোয়া করতেন-‘আল্লাহুম্মা যিদনা ওয়ালা তানকুসনা, ওয়া আকরিমনা ওয়ালা তুহিননা, ওয়া আতিনা ওয়ালা তুহরিমনা, ওয়া আসারনা ওয়া তুসির আলাইনা’, অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ! আমাদেরকে বৃদ্ধি করে দিন, হ্রাস করবেন না। আমাদেরকে সম্মানিত করুন, লাঞ্ছিত করবেন না। আমাদেরকে দান করুন, বঞ্চিত করবেন না। (মুসনাদে আহমদ : ১/১২৪)। হজরত উসাইদ ইবনে আবি তালেব (রা.) দোয়া করতেন-‘হে আল্লাহ! আমাদের সব কাজের আপনি উত্তম প্রতিদান দান করুন। দুনিয়ার লাঞ্ছনা ও আখেরাতের আজাব থেকে আমাদেরকে পরিত্রাণ দান করুন।’ (জামে সগির : ১৪৫০)
তওবা করা : প্রতিটি মুমিনের জন্য নিজের জীবনের ভালো-মন্দের জবাবদিহিমূলক হিসাব গ্রহণ করা উচিত। তওবা ও অনুতপ্ত হওয়ার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার প্রতি ধাবিত হওয়া আবশ্যক। তওবার শিক্ষা ধরে রাখা জরুরি। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনগণ! আল্লাহকে ভয় কর এবং প্রত্যেকেই ভেবে দেখুক আগামী সময়ের জন্য সে কী অগ্রিম পাঠিয়েছে এবং আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চিতভাবে জেনে রেখো, তোমরা যা কিছু কর সে সম্পর্কে তিনি পুরোপুরি অবগত।’ (সুরা হাশর : ১৮)
রোজা রাখার অনুশীলন : রমজানের আগে রোজা রাখার অনুশীলন করা। এ সময়ও রোজা, কুরআন তেলাওয়াতসহ অন্যান্য ইবাদতের অনেক ফজিলত। আল্লাহর আনুগত্য ও রমজানের প্রস্তুতির মোক্ষম মাস শাবান। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘রমজান ও রজবের মধ্যবর্তী মাস হলো শাবান। মানুষ এই মাসে উদাসীন থাকে। অথচ এই মাসে আমলসমূহ আল্লাহ তায়ালার কাছে উপস্থাপন করা হয়। সুতরাং আমি কামনা করি, আমি রোজা থাকাবস্থায় আমার আমলনামা আল্লাহ তায়ালার কাছে উত্থাপন করা হোক’ (নাসায়ি : ২৩৫৭)। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রমজানের পর নবী (সা.) শাবান মাসেই সবচেয়ে বেশি রোজা পালন করতেন’ (বুখারি : ১৯৭০)। নবী করিম (সা.)-এর দেখাদেখি সাহাবায়ে কেরামও (রা.) শাবান মাসে বেশি বেশি রোজা পালন করতেন।
অতীতের কাজা রোজা আদায় : সাহাবায়ে কেরাম (রা.) রমজান মাসের একটি প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন বিগত বছরের কোনো রোজা কাজা থাকলে আদায়ের মাধ্যমে। নতুন রমজান মাসের আগমনের আগেই কাজা আদায় করে নিতেন। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘বিগত বছরের রমজানের রোজা আমার ওপর আবশ্যক থাকলে, নতুন বছরের রোজা আগমনের আগে শাবান মাসে আমি সে রোজাগুলোর কাজা আদায় করে ফেলতাম।’ (বুখারি : ১৯৫০)
কুরআন তেলাওয়াত বৃদ্ধি : রমজান কুরআন অবতীর্ণের মাস। আর শাবান মাস হলো কুরআন তেলাওয়াতের মাস। হজরত হাবিব ইবনে আবি সাবেত (রহ.) বলতেন, শাবান মাস হলো কুরআন পাঠকারীদের মাস। সাহাবায়ে কেরাম ও তাবিয়িগণ এই মাসে অধিক পরিমাণ কুরআন তেলাওয়াতের উদ্দেশ্যে অন্যান্য ব্যস্ততা থেকে অবসর হয়ে যেতেন। শাবান মাসে তারা অসংখ্যবার কুরআন খতম করতেন।
ইফতারসামগ্রী বিতরণ : সাহাবায়ে কেরাম (রা.) সাধারণ জনগণের উপকার ও সহযোগিতার ব্যাপারে আন্তরিক খোঁজখবর রাখতেন। খাদ্য প্রদান একটি বড় জনসেবা। রমজানের প্রস্তুতি হিসেবে ইফতারসামগ্রী বিতরণ করতেন। আবদুল্লাহ ইবনে উমর, দাউদ তায়ি, মালেক ইবনে দিনার, আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) প্রমুখ ইফতারসামগ্রী প্রদানের প্রথম সারিতে ছিলেন। ইবনে উমর (রা.) এতিম-মিসকিন ছাড়া সাধারণত ইফতার করতেন না। চতুর্থ খলিফা আলি (রা.) বলতেন, বাজারে গিয়ে কোনো গোলাম ক্রয় করে আজাদ করার চেয়ে আমার কাছে বেশি উত্তম মনে হয়, আমি এক সা (শরিয়তের নির্দিষ্ট একটি পরিমাপ) খাবার প্রস্তুত করে সাহাবিদের আহারের ব্যবস্থা করি (মাজদি আল হিলালিকৃত ‘মাযা নুরিদু মিন রমজান’ : ১/১৩)। এখন থেকেই অভাবী পাড়া-প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনের খোঁজখবর বাড়িয়ে দেওয়া।
আমলের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকা : সাহাবায়ে কেরাম (রা.) নিজেদের আমলের ওপর সুদৃঢ় থাকতেন। অন্যদেরও এ ব্যাপারে উৎসাহী করতেন। দৃঢ়তার সঙ্গে সামান্য আমল অনিয়মিত বেশি আমলের চেয়ে উত্তম। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, একাগ্রচিত্তে ও আগ্রহভরে দুই রাকাত নামাজ অনাগ্রহের সঙ্গে সারা রাত নামাজের চেয়ে উত্তম। (মাজদি আল হিলালিকৃত ‘হাত্তা লা তাসখর রমজান’: ৩)
নবীজির (সা.) পক্ষ থেকে সুসংবাদ : রমজান মাসের আগমন ঘটলে নবী করিম (সা.) সাহাবাদের সুসংবাদ দান করতেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, ‘নবী করিম (সা.) নিজের সাথিদের রমজান মাসের সংবাদ দিয়ে বলতেন, তোমাদের মাঝে মোবারক মাস রমজানের আগমন ঘটেছে। আল্লাহ তায়ালা তোমাদের ওপর রমজানের রোজা ফরজ করেছেন। এই মাসে আসমানের দরজাসমূহ উন্মুক্ত করা হয়। জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। অভিশপ্ত শয়তানকে শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা হয়। এই মাসে আল্লাহর জন্য একটি রাত আছে যেটা এক হাজার রাত থেকে শ্রেষ্ঠ। যে ব্যক্তি এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো, সে সবকিছু থেকে বঞ্চিত হলো।’ (নাসায়ি : ২০৭৯)
চাঁদ দেখা : সাহাবায়ে কেরাম (রা.) রমজানের চাঁদ উদয়ের অপেক্ষায় থাকতেন। চাঁদ দেখার আশায় রাতে বের হতেন। তাদের হৃদয় ও অন্তর চাঁদ অবলোকনের প্রতি উৎসাহী থাকত। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা চাঁদ দেখে রোজা পালন কর এবং চাঁদ দেখে ইফতার কর।’ (বুখারি-মুসলিম)